1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

চৈনিক মুদ্রায় ঋণ ঝুঁকিহীন নয়

আসজাদুল কিবরিয়া, পরিকল্পনা সম্পাদক, ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস
আসজাদুল কিবরিয়া
১৭ মে ২০২৪

বাংলাদেশকে দেয়া চীনের বাণিজ্য-সুবিধা ঋণের প্রস্তাবটি একটি ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে৷ একে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ‘বাংলাদেশের মাটিতে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি’ হিসেবে দেখছে যা বিশেষ করে ভারতের জন্য ‘উদ্বেগজনক’৷

https://p.dw.com/p/4fxlV
২০১৪ চীন সফরে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার করমর্দন
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য রকম বিকশিত হয়েছেছবি: picture-alliance/dpa/W. Zhao/Pool

মার্কিন ডলারকে পুরোপুরি বাদ না দিতে পারলেও এর ওপর নির্ভরতা কিছুটা কমিয়ে বরং নিজস্ব মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তি করার একটা জোর তাগিদ বছরখানেক আগে শুরু হয়৷ চীন, ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও রাশিয়ার মতো কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ এই সুযোগে নিজেদের মুদ্রা দিয়ে আরো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পন্ন করার জন্য অনেকটা উঠে-পড়ে লাগে৷ সেই প্রয়াস এখনো বহাল আছে বটে, তবে উত্তেজনা কিছুটা মিইয়ে পড়েছে৷ কারণ, নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন নিষ্পত্তি করার কথা বলাটা যত সহজ, বাস্তবে তা সম্পন্ন করা ততো সহজ নয় বিশেষত প্রক্রিয়াগত জটিলতায় ও ব্যয়ের বিবেচনায়৷

তারপরও চীন ও ভারতের জোর চেষ্টা তাদের বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোকে যথাক্রমে চৈনিক মুদ্রা  ইউয়ান ও ভারতীয় মুদ্রা রুপি ব্যবহারে উৎসাহিত করায়৷ এসব মুদ্রা ব্যবহার করলে ডলারের ব্যবহার কম করতে হবে আর তাতে করে ডলারের দরের অস্থিরতা থেকে কিছটা স্বস্তি পাওয়া যাবে, এমন যুক্তিও দেয়া হচ্ছে৷ ইউয়ান ও রুপিকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ব্যবহার করার জন্য দুই দেশেরই অন্যতম পছন্দের বাণিজ্য অংশীদার বাংলাদেশ৷ হবেই বা না কেন? দুই দেশের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্যে বিশাল ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশের৷ কারণ, দুই দেশে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করা হয়, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি পণ্য আমদানি করা হয় তাদের কাছ থেকে৷

পরিসংখ্যান দেখা যাক৷ গত অর্থবছর মানে ২০০২-২৩ অর্থবছরের ভারতে প্রায় ২১৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে সেখান থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে প্রায় ৯৫০ কোটি ডলার৷ তাই ঘাটতি প্রায় ৭৩৭ কোটি ডলার৷ আর চীন দেশে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে একই সময়ে এক হাজার ৭৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে ঘাটতি গুণতে হয়েছে এক হাজার ৭১৫ কোটি ডলারের৷ যেহেতু পুরো লেনদেনই মার্কিন ডলারে করতে হয়েছে, সেহেতু ঘাটতি মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে টান পড়েছে৷  তাতে করে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে গিয়েছে৷ এখনো বাড়ছে৷ ফলে ডলারের ব্যয় কমানোর নানামুখী চেষ্টা চলছে – কম প্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল আমদানি নিরুৎসাহিত করাসহ বিভিন্নভাবে৷ তাতে কাজও হয়েছে কিছটা৷ ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য আমদানির ব্যয় প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে৷ আর চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেও এই ধারা অব্যাহত আছে৷

মুশকিল হলো, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে সাময়িকভাবে ডলার কিছুটা সাশ্রয় করা গেলেও সুদূরপ্রসারী ফলটা খুব সুখকর নয়৷ তাহলে উপায় কি? যাদের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি আছে, তাদের সাথে নিজ নিজ মুদ্রায় কিছুটা হলেও লেনদেন করা৷ চীন ও ভারত এরকমটাই বুঝাতে চাইছে তবে তাদের কথা হলো, শুধু তাদের মুদ্রা ব্যবহার করা যাবে, বাংলাদেশি টাকা নয়৷

এখানে তিনটি বিষয় মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রথমত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বর্তমানে পাঁচটি মুদ্রার সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক 'রিজার্ভ অ্যাসেট’ গঠন করে যা এসডিআর (স্পেশাল ড্রইং রাইটস) হিসেবে স্বীকৃত৷ মুদ্রাগুলো হলো: মার্কিন ডলার, ইউরো, চৈনিক রেনমিনবি বা ইউয়ান, জাপানি ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ড৷ দ্বিতীয়ত, বর্তমানে সারা দুনিয়ার সবদেশ মিলে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্র্রা রিজার্ভ বা মজুদ করছে, তার প্রায় ৫৯ শতাংশ এখন মার্কিন ডলারে (ডিসেম্বর, ২০২৩ পরযন্ত)৷ ২০২০ সালে এই হার ছিল ৭২ শতাংশ৷ আর বৈশ্বিক রিজার্ভের দুই দশমিক ৩০ শতাংশ হলো চৈনিক ইউয়ানে৷ আইএমএফের কারেন্সি কম্পোজিশন অভ অফিসিয়াল ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ  বা কফারের বাকী মুদ্রাগুলো হলো: ইউরো (২০ শতাংশ), ব্রিটিশ পাউন্ড ( চার দশমিক ৮৫ শতাংশ), জাপানী ইয়েন ( পাঁচ দশমিক সাত শতাংশ), কানাডীয় ডলার ( ‍দুই দশমিক ৬০ শতাংশ), অস্ট্রেলীয় ডলার (দুই দশমিক ১০ শতাংশ) এবং সুইস ফ্রাঁ৷ তৃতীয়ত,  আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তিতে চৈনিক ইউয়ান এখন চতুর্থ৷ মার্কিন ডলার, ইউরো ও ব্রিটিশ পাউন্ডের পর এর অবস্থান যদিও মোট  লেনদেনের প্রায় সাড়ে চার শতাংশ ইউয়ানে৷

এই তথ্যগুলো থেকে বোঝা যায় যে আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্য থেকে একমাত্র চৈনিক মুদ্রাই সবচেয়ে এগিয়ে আছে এবং ক্রমাগতভাবে জায়গা করে নিচ্ছে৷ সে তুলনায় ভারতীয় মুদ্রা রুপি অনেক পিছিয়ে আছে৷ বাংলাদেশ বা অন্য যে কোনো দেশ চাইলে ডলার বা ইউরোর মতো ইউয়ান ব্যবহার করেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দেনা-পাওনা মেটাতে পারবে, অন্তত কোনো দেশ এটা বলতে পারবে না যে এটি বৈশ্বিক স্বীকৃত মুদ্রার অন্যতম নয়৷ কিন্তু রুপির ক্ষেত্রে তেমন ‍সুযোগ খুব সীমিত৷ ভারতীয় রুপিতে ভারতের সাথে বাণিজ্য নিষ্পত্তি করার বিষয়ে ইতিমধ্যে একটা সিদ্ধান্ত হলেও তাতে তেমন অগ্রগতি নেই মূলত এই কারণে৷

এমতাবস্থায় গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেল যে চীন বাংলাদেশকে চৈনিক মুদ্রায় প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ দিতে চায় যার মূল্যমান তিন হাজার ৬০০ কোটি ইউয়ান বা ৫৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা৷ চীনের থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি ব্যয় এখনো ডলারে পরিশোধ করতে হয়৷ যদি কিছুটা হলেও চৈনিক মুদ্রায় শোধ করা যায়, তাহলে দেশ থেকে ডলার নির্গমন কিছুটা কমবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে, তাতেও একটু রাশ টানা যাবে৷

চীনের এই বাণিজ্য-সুবিধা ঋণের প্রস্তাবটি বাংলাদেশের জন্য নতুন ধরণের৷ ফলে যথেষ্ট পর্যালোচনার দাবি রাখে৷ ঋণের দায়দেনা শোধের ক্ষেত্রে সুদের হার ও সময়সীমা কতোটা নমনীয় হবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ৷  ইতিমধ্যে সরকারের মধ্যে প্রস্তাবিত ঋণটিকে দীর্ঘমেয়াদী ও সহজ শর্তে বাজেট সহায়তা ঋণ হিসেবে পাওয়া যায় কি না তা নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা করার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে৷

চৈনিক ঋণের প্রস্তাবটির একটি ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে৷ বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য রকম বিকশিত হয়েছে৷ একে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত 'বাংলাদেশের মাটিতে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি' হিসেবে দেখছে যা বিশেষ করে ভারতের জন্য ‘উদ্বেগজনক’৷ বাংলাদেশে পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে চীন অর্থায়ন ও বিনিয়োগ করেছে যার বড় অংশই ঋণ ৷ আরো কিছু প্রকল্পেও আগ্রহ আছে চীনের যা স্পষ্ট৷

কিন্তু ভারতের তাতে আপত্তি রয়েছে নিজেদের ভূ-কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে৷ সম্প্রতি সময়ে ভারত সরকারের প্রতিনিধি থেকে শুরু করে সেখানকার বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্র যেসব প্রতিবেদন-বিশ্লেষণ প্রকাশ করছে, তাতে এই ‘উদ্বেগ' যেমন স্পষ্ট, তেমনি ‘আপত্তি'র বিষয়টিতেও আর কোনো রাখঢাক নেই৷ তারা তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে এটাও বোঝানোর চেষ্টা করছে যে চীনের সাথে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নিজের বিপদ ডেকে আনছে৷ আর তাই চৈনিক ঋণের প্রস্তাবে বাংলাদেশ যেন ইতিবাচক সাড়া না দেয়, সেজন্য ভারতের দিক থেকে পরোক্ষভাবে আপত্তি তোলা হবে বলে ধরে নেয়া যায়৷

কিন্তু বিষয়টি বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় বিষয়৷ বাংলাদেশের মোট আমদানির এক-চতুর্থাংশ চীন-নির্ভর হওয়া এবং বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক চীনা কর্মীর উপস্থিতি বর্তমানে চৈনিক মুদ্রা ব্যবহারের প্রয়োজন বাড়িয়ে দিয়েছে৷ যদি আমদানি ব্যয়ের কিছুটা ও এখানকার চীনা কর্মীদের পারিশ্রমিকের অংশ বিশেষ ইউয়ানে পরিশোধ করা যায়, তাহলে কিছুটা হলেও সুফল মিলবে৷

বিষয়টা অবশ্য অতো সহজে সম্পন্ন হবে না৷ কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতাতো রয়েছেই৷ রয়েছে উচ্চহারে সুদসহ নানাবিধ ঝুঁকি৷ তারপরও ইউয়ানে ঋণ নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচক চিন্তা করতে পারে৷ নিজস্ব অব্যবস্থাপনায় ও অবহেলায় বাংলাদেশের আর্থিকখাতে সংকট দেখা দিয়েছে৷ ভূ-রাজনৈতিক সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি যে টালমাটাল হয়ে গেছে, তার নেতিবাচক প্রভাব যুক্ত হয়ে সংকটের মাত্রা বেড়েছে৷ তাই সংকট মোকাবিলায় কিছু ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতেই হবে৷ 

আসজাদুল কিবরিয়া, পরিকল্পনা সম্পাদক, ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস
আসজাদুল কিবরিয়া ঢাকাভিত্তিক দি ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের পরিকল্পনা সম্পাদক৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান